কিশোরীদের প্রথমবার মাসিক অথ্যাৎ ঋতুমতী হওয়ার (মেনার্কি) অভিজ্ঞতা হরেক রকম, আবার মহিলাদের রজোঃনিবৃত্তির (মেনোপজ) অভিজ্ঞতাও বহুবিধ। এই ভিন্নতার পেছনে প্রধান ভূমিকা জীব-বিজ্ঞানের। অবশ্য এক্ষেত্রে যেখানে আমরা থাকি সেই স্থান-কাল ও সংস্কৃতি, এগুলির ভূমিকাও অনস্বীকার্য। মাসিক বা ঋতুমতী হওয়া আমাদের শিশু অবস্থা থেকে শারীরিক পূর্ণাঙ্গতা পাওয়ার দিকে একটি ধাপ।
নারী শরীরে মাসিক কখন আরম্ভ ও শেষ হয়? না জানলে জানুন
মেয়েদের শরীরে ঋতুমতী / মাসিক /রজঃস্রাব হওয়ার সমসাময়িক আরও কয়েকটি ঘটনা হল স্তনের উদ্ভেদ, যৌনকেশ (অল্প বয়সী মেয়ে বা নারীদের কি যৌনকেশ নিয়মিত কামিয়ে ফেলা উচিত?) ও বগলের তলায় কেশের আগমন, এবং হঠাত্ উচ্চতা এবং ওজন বৃদ্ধি। এ সময়ে শরীরে হাড়ের শক্তি এবং পরিমাপ বাড়া বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু বয়স বিশের কোঠা পার না হওয়া পর্যন্ত হাড়ের ভিতরের বৃদ্ধি অব্যহত থাকে।
মেয়েদের শরীরের প্রজনন প্রক্রিয়া হর্মোন নিয়ন্ত্রণ করে। হর্মোন হল রক্তধারায় এবং মস্তিষ্কে অবস্থিত রাসায়নিক যা আমাদের শরীরের এক অংশ থেকে অপর অংশে সংকেত পৌঁছে দেয়। শরীরে যৌন হর্মোন গুলির পরিমাণ শৈশবে কম থাকে, প্রজননক্ষম বয়সে ভীষণ বৃদ্ধি পায়। তারপর এগুলি ক্রমশ কমতে থাকে ও রজোঃনিবৃত্তির পরে এগুলির অনুপাত বদলে যায়। প্রথম মাসিক বা ঋতুস্রাবের দিন থেকে রজোঃনিবৃত্তি পর্যন্ত জীবনে আমরা যে সমস্ত পরিবর্তন অনুভব করি, সেগুলি এই হর্মোনগুলির উপস্থিতির আনুপাতিক হার, কমা-বাড়ার জন্যেই হয়।
ডিম্বাণুর জন্ম এবং ঋতুস্রাব মাসিক মেয়েদের গড়ে সড়ে বারো বছর বয়সে শুরু হয়। তবে নয় থেকে আঠারো যে কোন বয়সেই এগুলি শুরু হওয়া স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়। ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার বয়স অনেকগুলি কারণে ভিন্ন হয়। এর মধ্যে কতকগুলি কারণ বৈজ্ঞানিক। যেমন একটি মেয়ের শরীরের স্নেহ বা চর্বির (ফ্যাট) ওজন তার শরীরের ওজনের এক চতুর্থাংশ হলে তবেই সে ঋতুমতী হবে। তাই মাসিক বা ঋতুচক্রের সঠিক বিবর্তনের জন্যে আমাদের খাদ্যতালিকায় সঠিক অনুপাতে স্নেহ জাতীয় পদার্থ (ফ্যাট), কার্বোহাইড্রেট, এবং প্রোটিন থাকা জরুরী।
আবার কতকগুলি কারণ আবহাওয়াজনিত। বিভিন্ন সংস্কৃতির আবহে বেড়ে ওঠা মেয়েরা বিভিন্ন সময়ে প্রথম ঋতুমতী হতে পারেন। যেমন তাইওয়ানের মেয়েদের প্রথমমাসিক বা ঋতুমতী হওয়ার গড় বয়স এবং আমেরিকার মেয়েদের প্রথম ঋতুমতী হওয়ার গড় বয়স আলাদা। আবার তাদের খাদ্যাভ্যাস, ওজন, জাতি, আবহ, এবং পারিবারিক ইতিহাসের ভিন্নতার ভিত্তিতে একই দেশের মেয়েদের প্রথম ঋতুমতী হওয়ার গড় বয়স বিভিন্ন হতে পারে।
মাসিক নিয়ে সনকা ও কল্পনার অভিজ্ঞতা
আমার মাসিক হয়েছিল ১৪ বছর বয়সে। এ রকম যে কিছু হয় আমি জানতাম না। মা কোনদিন কিছু বলেই নি! আমি ঠাকুরমার সঙ্গে পুজো দিতে গিয়েছিলাম – তখন হঠাত্ রক্তে আমার জামা ভেসে যায়। সে এক বিচ্ছিরি অবস্থা। ঠাকুরমা তাড়াতাড়ি বাড়ি নিয়ে আসার পর আমার বৌদি দেখিয়ে দেয় কি করে প্যাড পরতে হয়। আমাদের তো প্যাড কেনার পয়সা ছিল না, তাই পরিষ্কার ধোয়া কাপড় মাসিকের সময় ব্যবহার করতাম। আমার মেয়েকেও আমি কিছু বলতে পারি নি। ওর স্কুলের দিদিমণিরাই ওকে সব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আমার মেয়েকে আমি প্যাড পরতেই বলেছি। তাতে ও পরিষ্কার থাকে।
আমি ছোটবেলা থেকেই লোকের বাড়িতে থাকি, কাজ করি। সে রকম এক বাড়িতেই আমার মাসিক আরম্ভ হয়। আমাকে কেউই এ ব্যাপারে কিছু জানায় নি। বয়সে বড় অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে মিশে আমি সব কিছু জেনে গিয়েছিলাম। তাই যখন প্রথম মাসিক হল, কাউকে জানাই নি, কারোর সাহায্য নিতে হয় নি। কেমন করে কাপড় দিয়ে প্যাড বানাতে হয় তাও নিজের থেকেই শিখে নিয়েছিলাম। অত কাপড় তো ছিল না, তাই ব্যবহার করা কাপড়ই ভাল করে ধুয়ে নিতে হত। এ নিয়ে কারোর সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ হয় নি। এখন আমার মাসিক আর হয় না – কেন জানি না। বোধহয় তাড়াতাড়িই মাসিক শেষ হয়ে গেল।
প্রজননক্ষম বয়সে ডিম্বাণুর জন্ম ও ঋতুচক্র হর্মোন চক্রের ছন্দের ওপর নির্ভর করে। এই ঋতুচক্র মেয়েদের শরীরে সন্তান জন্ম দেবার উর্বরতা নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে প্রত্যেক মাসে মাত্র কয়েকদিন আমাদের শরীর গর্ভাধানের সম্ভাবনার জন্যে তৈরী হয়। অনেক মহিলার ক্ষেত্রে এই বিশেষ সময়ে বিশেষ কিছু লক্ষণ দেখা যায়, যেমন আবেগ-অনুভূতির পরিবর্তন, স্তনে তীক্ষ্ণ সংবেদনশীলতা ও আরও কিছু পরিবর্তন, বিশেষ বিশেষ খাবার খাওয়ার ইচ্ছে ইত্যাদি। মেয়েদের শরীরে ঋতুচক্র ও ডিম্বাণুর জন্ম গড়ে প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত চলে। তবে চল্লিশ থেকে পঞ্চান্ন বছর বয়সের মধ্যে যে কোনও সময়ে ঋতুচক্র বন্ধ হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়।
মাসিক বা ঋতুচক্র বন্ধ হয়ে গেলে রজোঃনিবৃত্তি (মেনোপজ) হয়েছে বলা হয়। মেয়েদের শরীরে প্রজননের ক্ষমতা থাকাকালীন অবস্থা এবং তার পরবর্তী কালে যে সমস্ত পরিবর্তন দেখা দেয় সেগুলি প্রায় পনেরো বছর ধরে চলতে পারে। ডিম্বাণু এবং রক্তস্রাব ঋতুচক্রের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকলে মাসিক চলাকালীন বা ঋতুকালীন সমস্যাগুলি, যেমন খিল ধরার ব্যথা ইত্যাদির ক্ষেত্রে কি করতে হবে তা বুঝতে সুবিধা হবে। এ বিষয়ে আগের সারণী, ছবি ইত্যাদি মনে রাখুন। সেখানে শরীরের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গগুলি এবং সেগুলির ভূমিকা বিষয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।